Skip to main content

টস্ (Toss)

অাজকের দিনটা একটু অদ্ভূত। সকাল থেকেই মনটা কির'ম এলোমেলো হয়ে অাছে মোহিতের। কাল রাতে নীলিমার সাথে ওই ঝগড়াটা না কি অাজ সকালে চাকরির ইন্টারভিউটা- ঠিক কোনটা তাকে বিচলিত করছে সে নিজেও ঠিক বোঝে না। ঘড়ির কাঁটা যেন অাজ একটু জোরেই ছুটছে। দেখতে দেখতে ৯টা বেজে গেল। ১১টার মধ্যে পৌঁছতে হবে অফিসটায়, নীলিমার বাবা সুপারিশ করেছেন বলেই যাওয়া। যা চাকরির বাজার, নয়তো মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কীবোর্ড ঠোকার কোন ইচ্ছেই মোহিতের ছিল না। ফোনে একটা ক্যাব বুক করবে ভাবে। তারপর কি মনে করে একটা ২০১ বাসে চড়ে যায় মোহিত, হুট করে অতগুলো টাকা খরচা করার মত মানসিকতা বা অার্থিক অবস্থা নেই ওর এখনও, সেই নিয়েই কাল রাতে নীলিমার সাথে শুধুমুধু ঝগড়াটা হল। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন সেক্টর ৫ এসে গেছে বোঝেইনি সে। নামার সময় এক ভিখারি হাত পেতেছিল, অন্যমনস্কভাবেই সে একটা দু' টাকার কয়েন দিল তাকে। লোকটা কয়েনটা ফিরিয়ে দিয়ে মোহিতকে বলল, "এ যে জালি টাকা গো!" মোহিত দেখল সত্যি তো, দুদিকেই হেড! স্ট্রেঞ্জ! কি যে হচ্ছে কাল থেকে!


রাস্তা পার করে অফিসটায় ঢুকতেই এসির ঠান্ডা বাতাসে শীত অনুভব করে মোহিত। ঠিক অভ্যস্ত নয় তো। ঘামে ভেজা জামাটা ঠিক করতে করতে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে অাসে, "মিঃ রয়ের সাথে মিট করার কথা ছিল, ইন্টারভিউ পারপাসে।"
রিসেপশনিস্ট রেজিস্টারটা এগিয়ে দিয়ে বলে, " এখানে একটা সই করুন" অার ডানদিকে লিফ্ট অাছে, সেকন্ড ফ্লোরে গিয়ে মিঃ রয়ের কেবিন বল্লেই দেখিয়ে দেবে।"
পকেট থেকে নিজের লাকি পেনটা বের করে সইসাবুদ সেরে লিফ্ট এ ঢোকে মোহিত। সে কি! ২ বলে তো কোন বাটন নেই। ১ অার ৩ এর মাঝে একটা বোতাম অাছে বটে কিন্তু তাতে F লেখা। সেটাই টেপে মোহিত। F থুড়ি ২য় ফ্লোরে লিফ্টের দরজা খোলে। এক বেয়ারা এসে সেলাম ঠোকে তাকে। মোহিত একটু অবাক হয় তবে ভাবে অাই টি ওয়ার্ল্ড এ এরম একটু চটকদারি থাকে বই কি। রিসেপশনের সোফাটায় বসতেই বেয়ারাটি বলে ওঠে, স্যার সে কি! কেবিনে গিয়ে বসুন। এখানে তো ইন্টারভিউইরা বসবেন। মোহিতের বিস্ময় বাড়তে থাকে! বেয়ারাটি একটু মাত্রাতিরিক্ত দরদ দেখাচ্ছে দেখছি। কেবিন এ ঢুকে মোহিত দেখে কেউ নেই ভেতরে। চেয়ারে বসে ইন্ট্রোটা কিভাবে দেবে সেটাই ভাবতে ভাবতে টেবিলের ওপর রাখা পেপারওয়েট টা নিয়ে গোল গোল ঘোরাতে থাকে। হঠাৎ সেটা দুম্ করে লাগে নেমপ্লেটটার গায়ে অার সেটা মেঝেতে পড়ে যায়।সেটা তুলতে গিয়ে দেখল নেমপ্লেটে লেখা, "মিঃ মোহিত সরকার, সি ই ও"। কি??


হঠাৎ দরজায় টোকা মারে কেউ। ধড়ফড় করে উঠে পড়ে মোহিত। ভুল দেখছে না তো! নীলিমা এখানে কি করে? সিঁথিতে হালকা সিঁদুর। কবে বিয়ে হল ওর? তবে কর্পোরেট লুকে বেশ মানিয়েছে। বলল, "মোহিত, অাজকে কিন্তু খুব প্যাক্ড স্কেডিউল। পরপর অনেক কটা ইন্টারভিউ নিতে হবে অাজ।
নেস্কট ক্যান্ডিডেট ঢুকবে অার দশ মিনিটের মাথায়, ততক্ষনে স্যান্ডউইচটা খেয়ে ফেল।"
- কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না।
-কবে বুঝেছিস? কোম্পানির সবকিছু সেই অামিই তো সামলাচ্ছি দশ বছর ধরে। টেকনিকাল দিকগুলো ছাড়া কিছুও দেখেন না অার একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে সরষেফুল দেখছেন চোখে।
-দশ বছর?
-ভগবান! দেখ কাজ শেষ হলে ঘরে ফেরার সময় একটা কেক নিয়ে ফিরিস। মোহিনীর জন্মদিন অাজ রাত বারোটায়। ভুলে মেরে দিস না।

মোহিনী? মোহিত + নীলিমা? ওর নিজের মেয়ে? নীলিমা কি তবে এখন মোহিতের স্ত্রী? কির'ম একটা অদ্ভূত ভালোলাগা কাজ করছিল মোহিতের মনে, এটা ভেবে যে কাল রাতের ঝগড়াটাই ওদের সম্পর্কের শেষ ছিল না। স্বপ্ন হোক বাস্তব হোক, যা কিছু হচ্ছে- মোহিতের ভীষণ ভালো লাগছে।
নীলিমা বেরিয়ে যায়। স্যান্ডউইচে কামড় বসায় মোহিত। "মে অাই কাম ইন?"- এক বয়স্ক কন্ঠস্বর। নেক্স্ট ক্যান্ডিডেট তার মানে। "ইয়েস কাম ইন!" কোথায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল। অার কি না এখন পাশা পাল্টে গেল।
ভদ্রলোক চেয়ারে বসলেন।
মোহিত বলল, "নিজের সম্বন্ধে কিছু বলুন"
-অামি অভিষেক রয়। অাজ দীর্ঘ ২০ বছর অাই টি ফার্মে কাজ করেছি। যথেস্ট নিপুনতা ও দক্ষতার সাথে নিজের কাজ করেছি। একটু ফ্র্যাঙ্কলিই বলছি, বর্তমানে অামার স্কিলসেটস্ ব্যাকডেটেড হয়ে যাওয়ায় অামি চাকরি হারাই। অাপনি অামার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট অার এই বয়সে যথেষ্ট established! এই ফিল্ডে অামি সেরম কাজও জানি না। তবে চাকরিটা এতটাই দরকার এই মূহুর্তে যে অাই অ্যাম রেডি টু অানলার্ন অ্যান্ড রিলার্ন।

মোহিত বোঝে ভদ্রলোক ঠিক চাকরিটা ভালোবেসে করতে চান না হয়ত! ওই পেটের দায়, মোহিতের মতই।

মোহিত- হবি অাছে কোন? সখ?
অভি- হ্যাঁ! অাছে তবে ঠিক চর্চা করা হয় না। এক সময় কম্পিউটার গ্রাফিক্স নিয়ে বেশ পড়াশোনা করতাম। অাঁকাঅাঁকি, লেখালেখি বেশ টানে অামাকে।
-বেশ! চাকরি পাকা অাপনার।
- কিন্তু ঠিক কোন ডোমেইনে কোন টুল এ কাজ করতে হবে?
-যেটা ভালোবাসেন সেটাই করবেন। অাজ থেকে অাপনি অামাদের কোম্পানির মার্কেটিং অার প্রমোশন ডিপার্টমেন্টের ক্রিয়েটিভ হেড।

অফার লেটার টায় সই করতে যাবে অমনি খেয়াল হল যাঃ লাকি পেনটা তো রিসেপশনেই ফেলে এসেছে।


-একটু বসুন অামি অাসছি।
এই বলে লিফ্টে চড়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে মোহিত রিসেপশনিস্টের থেকে পেনটা ফেরত নিয়ে লিফ্টে ওঠে। ও মা! এটা কি অন্য লিফ্ট না কি! এতে তো ২ বোতামটা অাছে। তাই টেপে মোহিত। ২য় ফ্লোরে লিফ্টের দরজা খুলতেই বুঝতে পারে মোহিত, যে এতক্ষনে বাস্তবের গল্পটা শুরু হল, সারি দিয়ে সোফায় বসে চাকরিপ্রত্যাশীরা - যাদের একজন সে নিজেও! বসে বসে ভুল ভাল চিন্তাভাবনা করতে থাকে অার একসময় তার ডাক পড়ে।
কেবিনে ঢুকে বেশ চমকে যায় মোহিত। এ..এ..এই লোকটার ই তো ইন্টারভিউ নিচ্ছিল সে! অভিষেক রয়! ইনিই তবে নীলিমার বাবার বন্ধু মিঃ রয়?
-কাম ইন্। হাও'স দ্য ডে?
-অাই অ্যাম স্টিল সিইং এ ড্রিম ইট সীমস।
-এত বড় কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে অাসা কি স্বপ্নের চেয়ে কিছু কম? তা তোমার পড়াশুনো মেক্যানিক্যাল নিয়ে! অার অ্যাপ্লাই করেছ ডেটা সায়েন্টিস্ট এর রোলে! কি জানো ডেটার ব্যাপারে?
-অাজ্ঞে! বিশেষ কিছুই জানি না। তবে কৌতুহল অাছে। জানতে চাই। এই মূহূর্তে চাকরির খুব দরকার অার অামি জানি অামি যে কোন কাজের দায়িত্ব নিলে সেটা বেশ দক্ষতার সাথে কমপ্লিট করি।
-ভালোই ঢাক পেটালে নিজের। তুমি কি জানো অামি অাজ এই ইন্ডাস্ট্রিতে গত ১০ বছর ধরে অাছি। এ হেন টুলস্ নেই যা অামি জানিনা। তবু তোমার মত বুক ফুলিয়ে অন্যের সুপারিশে ইন্টারভিউ দিতে এসে ঢাক পেটাবার বদান্যতা অামার নেই।
চেয়াল শক্ত হয়ে অাসে মোহিতের, অপমানগুলো অার যেন গেলা যাচ্ছে না।
-Where do you see yourself in next 10 years?
চোখে চোখ রেখে উত্তর দেয় মোহিত।
- "পরবর্তী দশ বছরে অামি অামার কোম্পানির সি ই ও হতে চাই যেখানে অামি কাউকে তার অ্যাকাডেমিক্স বা ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে judge না করে, তার পারদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে চাকরি দিতে চাই। চাই কেউ ভয় পেয়ে বা পেটের দায়ে নয়! কাজটাকে ভালোবেসে চাকরি করুক।"
এই বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। বেরোনোর অাগে একটা বাঁকা হাসি হেসে বলে, "কে বলতে পারে দশ বছর পর অাপনার মত হার্ডকোর কোডার কে হয়ত ক্রিয়েটিভ হেড বানিয়ে দিলাম"।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বুক পকেটে ফোন টা বেজে ওঠে। নীলিমা তো!
-হ্যাঁ নীলিমা বল!
-এখনও রাগ করে অাছিস বল? সত্যি বিয়ে বিয়ে করে এমন পাগল হয়েছি বুঝিওনি যে তোর ভালোলাগাটাই সবার অাগে। কেন যে জোর করলাম তোকে ওই অাই টির জব এর জন্য
-অারে বাবা ঠিক অাছে। অামি রেগে নেই।
-শোন জলদি অামার বাড়ি অায়। একটা দারুন স্টার্ট অাপের অাইডিয়া অাছে। অামি সব সামলাবো তুই শুধু টেকনিক্যাল দিকটা দেখিস...
মোহিত কেমন যেন বিবশ হয়ে যায় শুনতে শুনতে, F টিপে Future এ গিয়ে সবই যে তার দেখা.. অনেক হয়েছে দুঃখের বারোমাস্যা। জীবন যুদ্ধে এবার সে জিতবে। জিতবেই। পকেট থেকে অচল কয়েনটা বের করে টস্ করে একবার। যতই অচল হোক, হেড্ পড়বেই... মোহিত এবার জিতবেই।
লেখিকা :- পায়েল দাস

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাবা - আমার ছেলেবেলা

                                            দেখতে দেখতে তেইশটা বছর পেরিয়ে গেল – বাবাকে দেখিনি, গল্প করিনি, বাবার আদরের ছোঁয়া পাইনি…… বাবার কথা বলতে গিয়েই প্রথমে মনে পড়ে তাঁর মিষ্টি হাসিটা। আমার বাবা ছিলেন একেবারে মাটির মানুষ। আমার কখনো মনে পড়েনা যে বাবা আমাকে জোর গলায় কিছু বলেছেন বা বকেছেন। ছোটবেলায় আমি আর আমার বোন সঞ্চারী বাবার কাজ থেকে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকতাম – কেন না বাবা ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমাদের ভূতের গল্প শোনাবেন সেই আশায়! কী যে মজার দিন ছিল সেই সব... ছোটবেলায় আমার শখ ছিল পুতুল নিয়ে খেলার, খুব ভালবাসতাম। মনে পড়ে একবার বাবা আর মা বিদেশ থেকে ফেরার  সময় একটা Walkie Talkie Doll (পুতুল) নিয়ে এসেছিলেন। আমি  সেই পুতুলটিকে নিয়ে সারাদিন খেলতাম। একদিন একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে তার বাবামায়ের সাথে আর ওর –ও ঐ পুতুলটিকে খুব ভালো লেগে গেল। আমার নরম মনের বাবা আমাকে বললেন ‘মানা তুমি ওই বাচ্চাটিকে তোমার এই পুতুলটি দিয়ে দাও, আমি তোমাকে আবার...

আমরা তো হেমন্তই হতে চাইতাম

আজও বিকেলে মাঝে মাঝে খুব হেমন্ত শুনতে ইচ্ছে হয়..... "কোনোদিন বলাকারা এতো দূরে যেত কি "...... কিংবা "ওলির কথা শুনে বকুল হাসে ".......আজও মনে পরে "বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই ".......বা "সারাটি দিন ধরে / চেয়ে আছিস ওরে /তোর মনে কথা তবুও কেউ জানলো  না"......আকাশে মেঘ করলেই মনে পরে "মেঘের স্বপন দেখি "......শুধু একজনের জন্য।...... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । কখনো আবার বেশি রাতে আজও  শুনি বিবিধ ভারতীতে.... "তেরি দুনিয়া মে জিনিসে /তো বেহতর হ্যায় / কে মর যায়ে ".....আর সাথে যদি হয় 'ছুঁপালো যুঁ দিল মে প্যার মেরা " ...তাহলে তো কথাই নেই।   বাবাদের ছেলেবেলায় খুব প্রিয় ছিল " শূর্পনখার নাক কাটা যায় / উই কাটে বই চমত্কার / খদ্দের কে জ্যান্ত ধরে / গলা কাটে দোকানদার "........ মা এখনও  শুনতে চায় "ঘুম যায় ওই চাঁদ মেঘ পরীদের সাথে "......জ্যাঠার ঘরে বসে কত দুপুর কেটেছে শুধু "বসে আছি পথ চেয়ে"........ সেই কোন ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি "যদি জানতে চাও তুমি / এব্যাথা আমার কত টুকু / তবে বন্দি করা কোনো পাখির কাছে জেনে ...

একই সুরে কত গান

বিষয়টা খুব একটা নতুন নয়।  যদিও বেশ আকর্ষণীয়।  গান আমরা প্রায় সকলেই শুনি।  এবং এও জানি যে এমন গান আছে যা শুনলে হঠাৎ করে মনে হয় "আরে   এই গানটার  একটা হিন্দি আছে না?" বা " এই গানটার বাংলা টা  যেন কি?"  এবং এই গানগুলির বিষয়ে মানুষের এক-ধরণের স্বভাবজাত আকর্ষণ ও আছে।  তাই ভাবলাম দেখি কিছু লেখা যায় কিনা।  মজার ব্যাপার সব গান নিয়ে লেখা খুব একটা সহজ নয়।  তবুও চেষ্টা করে দেখতে গেলে ক্ষতি কি।     প্রথমেই আসা যাক সলিল চৌধুরীর গান -এ।  তিনিই এই কাজ প্রথম শুরু করেন বলেই মনে হয়।  না ভুল হলো তার আগে শচীন কর্তাও আছেন।  তবে আগে সলিল চৌধুরীকে  নিয়েই হোক।  লতাজিকে দিয়ে তিনি ৩৫টি বাংলা  আধুনিক  গান গাইয়ে  ছিলেন।  যার ২৯ খানারই অন্য ভার্সন আছে।  ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত "যারে যারে উড়ে যারে পাখি " গানটির  হিন্দি  ছিল ১৯৬১ সালে প্রকাশিত "মায়া" হিন্দি ছবির " যারে যারে উড় যারে পঞ্চী " . "যারে যারে উড়ে যারে পাখি " এর উল্টো দিকে ছিল " না যেও না" যার হিন্দি ছিল ১৯৬০ সালে...