দেখতে দেখতে তেইশটা বছর পেরিয়ে গেল – বাবাকে দেখিনি, গল্প করিনি, বাবার আদরের ছোঁয়া পাইনি……
বাবার কথা বলতে গিয়েই প্রথমে মনে পড়ে তাঁর মিষ্টি হাসিটা। আমার বাবা ছিলেন একেবারে মাটির মানুষ। আমার কখনো মনে পড়েনা যে বাবা আমাকে জোর গলায় কিছু বলেছেন বা বকেছেন।
ছোটবেলায় আমি আর আমার বোন সঞ্চারী বাবার কাজ থেকে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকতাম – কেন না বাবা ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমাদের ভূতের গল্প শোনাবেন সেই আশায়! কী যে মজার দিন ছিল সেই সব...
ছোটবেলায় আমার শখ ছিল পুতুল নিয়ে খেলার, খুব ভালবাসতাম। মনে পড়ে একবার বাবা আর মা বিদেশ থেকে ফেরার সময় একটা Walkie Talkie Doll (পুতুল) নিয়ে এসেছিলেন। আমি সেই পুতুলটিকে নিয়ে সারাদিন খেলতাম।
একদিন একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে তার বাবামায়ের সাথে আর ওর –ও ঐ পুতুলটিকে খুব ভালো লেগে গেল। আমার নরম মনের বাবা আমাকে বললেন ‘মানা তুমি ওই বাচ্চাটিকে তোমার এই পুতুলটি দিয়ে দাও, আমি তোমাকে আবার একটা ঐরকম পুতুলই এনে দেব। আমি খুবই দিতে অনিচ্ছুক, কিন্তু বাবার কথা অমান্য করতাম না তাই দুঃখিত মনেই ওকে পুতুলটি দিয়ে দিলাম।
কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছিলাম যে বাবা এই দেওয়ার ভিতর দিয়ে একটি বড় শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন আর বলেছিলেন যে সবকিছুই ভাগ করতে হয় সবার সাথে বা share করতে হয়। উনি বলতেন ‘যত মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করবে, তাদের জন্য দুঃখে –সুখে পাশে থাকবে, সবাই তোমাকে আরও ভালোবাসা দেবেন।
বাবার লেখা আর সুরে আমি ছোটবেলায় যে ছড়ার গান করেছিলাম ‘এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে’ তার একটা লাইন আমি তুলে ধরছি – “মা আর বাবা বলেছে ছি ছি ছি, ঝগড়া কোরোনা মিছিমিছি, সব্বাই ভালো নিজে ভালো হও, ভালোবেসে জয় করে নাও, তাই ভাব ভাব ভাব, সবার সাথে ভাব, ভালো ছেলেমেয়েদের নেই কো অভাব”- আমি এই চিন্তাধারাটাই আমার জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।
ছোটবেলায় যখন আমি পড়তে চাইতাম না মার কাছে বকুনি খেতাম আর তারপর মুখ গোমড়া করে বসে থাকতাম – কখন বাবা বাড়ি ফিরবেন, আর যেই না বাবা বাড়ি ঢুকতেন আমি ভ্যা করে কেঁদে উঠতাম – বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম যে মা মেরেছে ! বাবা তখন মা কে বকা দিত আর সেটাতেই আমি ভারি মজা পেতাম।
বাবার মনটা ভীষণ নরম ছিল। আমাদের কারোর জ্বর বা শরীর খারাপ হলে বাবা খুব অস্থির হয়ে পড়তেন। একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল আর বাবা সারারাত আমার মাথায় ভিজে কাপড়ের জল পট্টি দিয়েছিলেন আর মাথায় আর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্নেহের স্পর্শ কি ভোলা যায়!
একদিন টেলিভিশনে ‘আনন্দ’ সিনেমা চলছিল। আমরা সবাই দেখছি শেষের দৃশ্যে যেখানে ‘রাজেশ খান্না’ মারা যাবার দৃশ্যটি দেখাচ্ছে – আমি বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি যে বাবার চোখে জলের ধারা – খুব চেষ্টা করে লুকোতে চাইছিলেন যাতে আমরা না দেখি - বা বুঝতে না পারি, আমি তখনই গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরি!
একটি মজার ঘটনা – আমার প্রথম হিন্দি সিনেমা ‘মিনু’ ছবিতে গান রেকর্ডিং এর শেষে বাবা খুব খুশিতে আমাকে কোলে তুলে নেন আর আমি তার পর থেকে প্রত্যেকটা গানের রেকর্ডিং এর শেষে বাবাকে বলতাম ‘বাবা কোলে’! ওটাই ছিল আমার ‘gift’! তারপর একটা সময় এল যখন আমি অনেকটাই লম্বা হয়ে গেছি আর বাবাকে বলেছিলাম কোলে তোলার জন্য – বাবা তখন বলেছিলেন ‘আমি কি আর পারি মা, তুমি তো এখন বড় হয়ে গেছ !’ এই সব ঘটনাগুলো এখন মনে পড়ে আর চোখ দুটো জলে ভরে আসে…
বাবা ছিলেন কষামাংস রান্নার expert! যেদিন বাবা কষামাংস রাঁধতেন - আমরা ভাইবোনেরা তা চেটেপুটে খেতাম আর অপেক্ষা করতাম আবার কবে বাবা মাংস বানাবেন। আমি মাঝেমধ্যেই বাবার সাথে বেকবাগান বাজারে যেতাম আর list দেখে বলতাম কি কি সামগ্রী লাগবে। বাবা যেদিন রান্না করতেন সেদিন আর কেউ রান্নাঘরে ঢুকতে পারত না! বাবার সবকিছুই ছিল grand scale এ, ঠিক যেমন তাঁর সব রচনা ছিল দুর্দান্ত আর grand! বাবা মজা করে মা কেও বলতো যে ভালো শিল্পী হতে গেলে ভালো রান্নাও করতে হয়!
বাবার কাছে আরো একটা জিনিস শিখেছি যে ‘health is wealth’! বাবা নিয়মিত যোগা করতেন আর আমাদের ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এ ভোরবেলা নিয়ে যেতেন morning walk এর জন্যে। এক এক দিন আবার ফেরার পথে গরম গরম জিলিপি কেনা হত তিওয়ারির দোকান থেকে। আহা কী দারুণ দিন ছিল ওই সব…
বাড়িতে ফিরে বাবা বসে যেতেন পিয়ানোর সামনে – নতুন কোনো সুর তৈরি হলেই মা কে বা আমাকে ডাক দিতেন। বলতেন ‘চটপট এই সুরটা তুলে নাও।‘ আমি গাইতে থাকতাম আর তার উপর বাবা কথা লিখে চলতেন – আর তখনই সৃষ্টি হতো একটি নতুন গান। আমার গাওয়া একটি গান – ‘এই সারাটা দেশ জুড়েই আমার ঘরবাড়ি’ এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল।
আমার ছোড়দা সঞ্জয় চৌধুরী ও ভাল সুরকার। বাবা একদিন ওকে ডেকে বললেন ‘পিপি তুই কি নতুন সুর বানিয়েছিস শোনা দেখি’ –দাদা শোনাল – শুনে বাবার খুব ভাল লাগলো আর বললেন ‘দাঁড়া তোর জন্যে এর ওপর আমি এখুনি গরম গরম কথা লিখে দিচ্ছি।‘ আমাকে বললেন ‘তুমি সুরটা গাইতে থাকো – আমি গাইলাম আর দেখি বাবা সুরের সাথে সাথে কথা লিখে ফেললেন ‘চল মাঝি বইঠা ধর ওপার যাই’। গানের সুরের সাথে কথা এমন ভাবে মিশে গেল যে মনে হল যেন ওই গানটার সুর বাবারই তৈরি করা! এইরকমই ছিল সলিল চৌধুরীর প্রতিভা!
ভোলা কি যায়ে ছেলেবেলার সেই সব দিনের কথা! বাবার হাত পিয়ানোর রীড এ – চোখ বন্ধ করে তিনি বাজিয়ে চলেছেন আর মা, সঞ্চারী আর আমি একসাথে Harmony করে গান গাইছি ‘সুরের এই ঝরনা’।
আমার জীবনে বাবার প্রভাব সীমাহীন! তাইতো তাঁর জীবনের দর্শন বা philosophy কে সঙ্গে করে বাকী জীবনের পথ চলা আমার। তাঁরই মত করে মানুষ হবার চেষ্টা! বাবা বলতেন ‘আগে ভাল মানুষ হও – তবেই তো ভাল শিল্পী হতে পারবে!’ পরিশেষে বলি – ‘আমার প্রার্থনা এই শুধু যেন তাঁদের আশীর্বাদে আমি জন্মজন্মান্তরে তাঁদেরই সন্তান হয়ে জন্ম নিই তাঁদেরই কোলে!
~ অন্তরা চৌধুরী


Comments
Post a Comment